শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র – বর্তমান অবস্থা ও অবদান
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ভোলা জেলা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই নয়, প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার হিসেবেও বিখ্যাত। সেই ভাণ্ডারের এক উজ্জ্বল রত্ন হল শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র। তাই আজকে আমি আপনাকে সাহাবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে বিস্তারিত বলবো।
আবিষ্কার ও অবস্থান
১৯৯৫ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ”বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)”- কর্তৃক আবিষ্কৃত এই গ্যাসক্ষেত্র টি বোরহানউদ্দিন উপজেলার বোরহানগঞ্জের দক্ষিণে অবস্থিত।
শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের ভূতত্ত্ব (বিস্তারিত বিশ্লেষণ)
আপনি যেন শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারনা নিতে পারেন সে কারণে এবার আমি উক্ত স্থানটি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষন করবো। যা নিচে ধাপে ধাপে শেয়ার করা হলো।
গ্যাসক্ষেত্রে এর অবস্থান-
শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র বরিশাল বিভাগের ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বোরহানগঞ্জের দক্ষিণে ৪ নং কাচিয়া ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। ভোলা উত্তর-১ গ্যাসক্ষেত্র থেকে এটি প্রায় ৩২ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
ভূতাত্ত্বিক কাঠামো-
এই গ্যাসক্ষেত্রটি বঙ্গীয় অববাহিকায় অবস্থিত। এই ভূ-কাঠামোটির ভূতাত্ত্বিক নাম ‘ভূস্তরীয় কাঠামো’। দেশের অন্যান্য গ্যাস ক্ষেত্র (যেমন: টিটি, বিবিয়ানা, রশিদপুর) সুরমা অববাহিকায় আবিষ্কৃত হয়েছে, যার ভূতাত্ত্বিক নাম ‘ঊর্ধ্ব ভঙ্গ কাঠামো’।
ভূস্তরীয় কাঠামোর বৈশিষ্ট্য-
ভূস্তরীয় কাঠামো সাধারণত পলল পদার্থ দ্বারা পূর্ণ থাকে। এই কাঠামো গুলোতে তেল ও গ্যাসের আধার থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রে মূলত বালুপাথর এবং শেল পাথরের স্তর বিদ্যমান। আর এখানকার গ্যাস মূলত বালু পাথরের ছিদ্রযুক্ত স্তরে আটকা থাকে।
শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের আবিষ্কার
বর্তমান সময়ে আমরা যেমন শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র দেখতে পাচ্ছি অতীতে সেটি এমন ছিলোনা। বরং বিভিন্ন সময় ধাপে ধাপে এই গ্যাসক্ষেত্র এতোটা উন্নত হতে পেরেছে। আর সেই শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সকল ইতিহাস গুলো নিচে তুলে ধরা হলো।
ভোলায় গ্যাসের প্রাপ্যতা-
জিওলজি অ্যান্ড জিওপিজিক্স লিমিটেডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভোলায় গ্যাসের প্রাপ্যতা প্রথম জানা যায় ১৯৫২ সালে। এরপর পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানি একটি দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ পরিচালনা করে।
স্বাধীনতার পর-
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, ১৯৭৪-৭৫ সালের মধ্যে দ্বিতীয় ধাপে একটি ভূকম্পন জরিপ পরিচালিত হয়।
শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান-
বাপেক্স সূত্রমতে, ১৯৮৬ সালে ভোলায় একটি দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের মাধ্যমে শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যায়।
খনন কার্যক্রম-
পেট্রোবাংলা ১৯৮৭ সালে তৃতীয় ধাপে আরেকটি ভূকম্পন জরিপ পরিচালনা করে। জরিপটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯৪ সালে শাহবাজপুর-১ গ্যাসক্ষেত্রে খনন কার্যক্রম শুরু হয়।
শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র: বর্তমান অবস্থা ও অবদান
বর্তমানে শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের আওতায় মোট ৬ টি কূপ রয়েছে। এর মধ্যে কাচিয়া ১ ও ২ নং গ্যাসক্ষেত্রে ৪ টি, ভোলা ভেদুরিয়ায় ১ টি এবং টগবীর মুন্সিরহাট বাজার সংলগ্ন এলাকায় ১ টি কূপ অবস্থিত। এই ৬ টি কূপের মধ্যে ৪ টি থেকে বর্তমানে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন-
শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস ব্যবহার করে ভোলার বোরহানউদ্দিনে ৩৫.৫ মেগাওয়াট রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট ও ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলো দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
আবাসিক গ্যাস সংযোগ-
শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো ভোলার আবাসিক লাইনে গ্যাস সরবরাহ। সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস সংগ্রহ করে ভোলার অনেক পরিবারে গ্যাস সংযোগ সরবরাহ করছে। যার ফলে ভোলায় অবস্থান করা পরিবার গুলোর জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব-
শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র ভোলার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। এই গ্যাসক্ষেত্রের কারণে সেই এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নত হচ্ছে। এছাড়াও বিদ্যুৎ সরবরাহ বৃদ্ধির ফলে নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
স্থানীয় অবকাঠামোয় ইতিবাচক প্রভাব
শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে ভোলা অঞ্চলে স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়নেও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো।
যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি-
গ্যাসক্ষেত্রে কর্মী ও সরঞ্জাম পরিবহনের জন্য এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নতি ঘটানো হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থাও উন্নত হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন-
গ্যাস কোম্পানি কর্তৃক এলাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সহায়তা করা হচ্ছে। এছাড়াও, স্থানীয়দের জন্য বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যা তাদের কর্মসংস্থানের দ্বার খুলে দিচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
যদিও শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র অঞ্চলের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে, তবে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আর যদি আমরা এই চ্যালেঞ্জ্য গুলোর মোকাবিলা করতে না পারি তাহলে ভবিষ্যতে আরো বড় সমস্যা হতে পারে। যেমন,
কূপের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস –
প্রাকৃতিক কারণে কিছু কূপের উৎপাদন ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এজন্য নতুন কূপ খনন ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বজায় রাখা জরুরী।.
পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি-
গ্যাস উত্তোলন ও পরিবহনের সময় কঠোর পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মেনে চলা জরুরী। পরিবেশ দূষণ রোধে কর্তৃপক্ষকে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
গ্যাসক্ষেত্র বাজার: অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র
শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র কেবল জ্বালানি সরবরাহের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি স্থানীয় অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। গ্যাসক্ষেত্রের আশেপাশে বাজার গড়ে ওঠার ফলে এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হচ্ছে।
বাজারের বিকাশ-
গ্যাসক্ষেত্র শুরু হওয়ার সময় এখানে মাত্র এক দুইটি দোকান ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে গ্যাসক্ষেত্রে কর্মরত কর্মী ও স্থানীয় জনগণের চাহিদা পূরণে এখানে দোকানপাট বাড়তে থাকে। বর্তমানে এখানে সব ধরণের জিনিসপত্রের দোকান পাওয়া যায়।
অর্থনৈতিক প্রভাব-
বাজারের বিকাশের ফলে এলাকায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হচ্ছে। যার ফলে স্থানীয় জনগণ কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়াও বাজারে বিক্রি হওয়া জিনিসপত্রের বেশিরভাগই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় যা স্থানীয় অর্থনীতিকে আরো উন্নত করছে।
আরো পড়ুন:
আপনার জন্য আমাদের কিছুকথা
সাহাবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র, শুধু একটি নাম নয়, বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার অন্যতম সম্পদ। যে সম্পদ আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।কিন্তু এই মূল্যবান সম্পদ কি চিরস্থায়ী? ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য কি বার্তা বহন করে?
মনে রাখবেন, সাহাবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের ভাগ্য আমাদের হাতে। এটি রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য, আমাদের দায়িত্ব, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার। আসুন আমরা সকলে মিলে এই সম্পদকে জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতার সাথে ব্যবহার করি।