রসায়ন কাকে বলে?
রসায়ন কি | রসায়ন কাকে বলে? | রসায়নের জনক কে? | Rosayon Kake Bole
প্রাচীন বিজ্ঞানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো রসায়ন। আগুন আবিষ্কারের পর থেকেই মানব সভ্যতায় রসায়নের ব্যবহার শুরু হয়েছে। বিজ্ঞানের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো রসায়ন। রসায়ন কাকে বলে যেখানে পদার্থের উপাদান এবং পদার্থের বৈশিষ্ট্য, গঠন এবং পারস্পরিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় কীভাবে পদার্থের গঠন পরিবর্তন করতে পারে এবং যখন পরিবর্তিত হয় তখন যে শক্তি নির্গত বা শোষিত হয় এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় তাই রসায়ন।
রসায়ন একটি জটিল বিষয়। যদি আপনি রসায়ন কাকে বলে সঠিকভাবে শিখতে চান তবে এ বিষয়টি নিয়ে ভালোভাবে জানতে ও পড়তে হবে।ধীরে ধীরে অধ্যয়নের মাধ্যমে এটি সহজ বিষয় হতে পারে।
আমরা আজকে জানব, রসায়ন কাকে বলে? রসায়নের জনক কে?এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে পুরো আর্টিকেলটি পড়ুন।
রসায়ন কাকে বলে?
বিজ্ঞানের যে শাখায় পদার্থের গঠন, ধর্ম এবং পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে রসায়ন বলে।বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে রসায়ন মূলত পদার্থ গঠনকারী বিভিন্ন উপাদানসমূহ নিয়ে কাজ করে। এসকল উপাদানের আচরণ কেমন,অন্য উপাদানের উপস্থিতিতে কেমন প্রতিক্রিয়া হয়, এসব বিষয় রসায়নের আলোচ্য বিষয়।
রসায়ন প্রাথমিকভাবে অণু,পরমাণু এবং আয়ন এর উপর গুরুত্ব দেয় এবং কিভাবে এগুলো মৌল ও যৌগ গঠন করে তার ধারণা দেয়।এসব উপাদানগুলো মৌল ও যৌগ গঠনকালে যেভাবে পরস্পরের সাথে যুক্ত হয় বা পদার্থের অভ্যন্তরীন গঠনের পরিবর্তন করে সেসব কিছুই রসায়নের আলোচনার বিষয়। বিজ্ঞানের সব শাখার সাথে রসায়নের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে বলে একে কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানও বলে।
আরো দেখুনঃ বিজ্ঞান কাকে বলে?
রসায়নের ইংরেজি কি?
ইংরেজি Chemistry (কেমিস্ট্রি) শব্দের প্রতিশব্দ হলো রসায়ন। মধ্যযুগে মুসলিম বিজ্ঞানীরা পরশ পাথরের সন্ধান করতে গিয়ে একটি শাস্ত্র বা পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। যেটাকে তারা নাম দিয়েছিলেন আলকামিস্তা বা আলকেমি। আর এ আলকেমি শব্দটি এসেছে আরবী শব্দ আল-কিমিয়া থেকে। আবার আল-কিমিয়া শব্দটি এসেছে ‘কিমি’ থেকে। এই ‘কিমি’ শব্দটি থেকেই Chemistry শব্দের উৎপত্তি। আলকেমি শব্দের ‘আল’ অর্থ দি(The) এবং ‘কেমি’ বা ‘কিমি’ অর্থ ব্লাক সয়েল বা কালো মাটি। এই কালো মাটি হলো মিশরের নীল নদের তীরের মাটি। এই গবেষকদের বলা হতো আলকেমিষ্ট (Alchemist) ৷
রসায়নের জনক কে?
আমরা জানি রসায়ন শাস্ত্রের জনক হচ্ছেন মুসলিম রসায়ন বিজ্ঞানী জাবির-ইবনে-হাইয়ান। এই মুসলিম রসায়ন বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম রসায়নশাস্ত্র নিয়ে এতটা বেশি গবেষণা করেন যে কারনে রসায়ন শাস্ত্রের জনক হিসেবে তার নামটি ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।প্রায় 700 থেকে 800 খ্রিস্টাব্দ এর মধ্যবর্তী সময়ে তিনি রসায়ন নিয়ে গবেষণার কাজ করেছিলেন।
জাবির-ইবনে-হাইয়ান এর রসায়ন গবেষণা ছিল একটি বিশেষ সাংকেতিক ভাষায় লেখা। তবে বর্তমানে খুব বেশি কেউ এ সাংকেতিক ভাষা বোঝেনা। বিশেষজ্ঞদের মতে এসব ছিল রাসায়নিক সংকেত। তার লিখিত আলকেমিতে সেসময় আরবে প্রচলিত বিভিন্ন পদার্থের নামের বিস্তৃত রাসায়নিক সংখ্যায়ন পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন।এই মহান বিজ্ঞানীর আবিষ্কার পদ্ধতি বর্তমান সময় বহুল ব্যবহৃত হয়।
তবে রসায়ন শাস্ত্রের জনক জাবির-ইবনে-হাইয়ানকে বলা হলেও আধুনিক রসায়নের জনক হচ্ছেন মহান বিজ্ঞানী লরেন্ট ল্যাভয়সিয়ে।
এই বিজ্ঞানী রসায়নকে বিজ্ঞানের উপযোগী করে তুলেছিলেন যাতে অন্যরা তার সংকেত গুলো দিয়ে খুব সহজেই সফলতা অর্জন করতে পারে। তার সংকেতগুলো ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা রসায়নশাস্ত্রকে পরিপূর্ণ হতে সাহায্য করেছে।এছাড়া রসায়নের প্রকৃত রহস্য উদ্ভাবন করে রসায়ন চর্চায় ভূমিকা রাখেন রবার্ট বয়েল, স্যার ফ্রান্সিস বেকন এবং জন ডাল্টন সহ অন্যান্য বিজ্ঞানীরা।জন ডাল্টনকে আধুনিক রসায়নের পথিকৃৎ বলা হয়।
আরো দেখুনঃ পরমাণু কাকে বলে?
রসায়নের ইতিহাস
রসায়নের ইতিহাস একটি অনেক পুরনো বিষয়। আজ থেক ৫০০০ বছর পূর্বে ভারতবর্ষে কাপড়কে আকর্ষণীয় করে তুলতে রঙের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ভারতীয় ঋষিরাও চাইতেন এমন কিছু তৈরি করার যার মাধ্যমে অমরত্ব লাভ করা যায়। যাকে তারা বলতেন পরশ পাথর!
খ্রিষ্টপূর্ব 3500 অব্দের দিকে মানুষ পশু শিকার, ফসল ফলানো, জ্বালানি হিসেবে কাঠ সংগ্রহ সহ প্রোয়োজনীয় অনেক কাজে একধরনের অস্ত্র ব্যবহার করত৷কপার ও টিনকে গলিয়ে একত্র করে এ মিশ্রণকে ঠান্ডা করে কঠিন শংকর ধাতুতে পরিণত করা হয়৷ এ শংকর ধাতুটিই হল ব্রোঞ্জ৷ এ ব্রোঞ্জ দিয়ে খুব ভালো অস্ত্র তৈরি করা যেত।
এ ব্রোঞ্জ তখনকার মানবজাতির জন্য ছিল এক অতি প্রয়োজনীয় জিনিস ও আবিষ্কার।ব্রোঞ্জ আবিষ্কার মানব সভ্যতাকে অনেকদুর এগিয়ে নিয়ে যায়৷
খ্রিষ্টপূর্ব 380 অব্দের দিকে গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস বলেন যে, প্রত্যেক পদার্থকে ভাঙতে থাকলে শেষ পর্যায়ে এমন একটি ক্ষুদ্র কণা পাওয়া যাবে যাকে আর ভাঙা যাবে না৷তিনি এ কণার নাম দেন এটম (Atom) যার অর্থ অবিভাজ্য ৷
প্রায় একই সময়ে আরিস্টটলসহ অন্যান্য দার্শনিকেরা মনে করতেন সকল পদার্থ মাটি, আগুন, পানি ও বাতাস মিলে তৈরি হয়৷ ফলে এটমের ধারণা অনেকদিন পর্যন্ত মানুষ গ্রহণ করেনি৷
মধ্যযুগে আরবের কতিপয় মুসলিম গবেষকরা কপার, টিন, সিসা এসব সল্পমূল্যের ধাতু থেকে সোনা তৈরি করতে চেয়েছিলেন৷ সেই সাথে তারা এমন একটি মহৌষধ তৈরি করার চেষ্টা করেন যা খেলে মানুষের আয়ু অনেক বেড়ে যাবে৷
তারা অবশ্য এগুলোতে সফল হননি তবে তারা অনেক চেষ্টা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন যা প্রশংসনীয়৷ যার ফলস্বরূপ সোনা বানাতে না পারলেও বিভিন্ন পদার্থ মিশিয়ে সোনার মত দেখতে এমন অনেক পদার্থ তৈরি করেছিলেন এবং এসব গবেষণার বিষয়গুলো লিখে রেখেছিলেন৷মূলত এসব গবেষণাকেই রসায়নের ইতিহাসে প্রথম পদ্ধতিগত রসায়নের গবেষণা বলতে পারি।
রসায়ন চর্চায় প্রাচীন মিশরীয়দের অবদানও অনেক।কারন মিশরীয়রা যে মমি তৈরি করতো তাতে তারা নানান রকমের রাসায়নিক ব্যবহার করতো।
প্রাচীন গ্রীসেও রসায়নের চর্চা শুরু হয়েছে সুপ্রাচীনকাল থেকেই।গ্রিকরা জীবন সঞ্জিবনী তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন!আর এ বিদ্যা সম্পর্কপ অবগত ছিলেন জাবির-ইবন- হাইয়ান।তার পিতা ইবনে হাইয়ানও এ গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারী ছিলেন। প্রাচীনকালে রসায়নকে গুপ্ত বিদ্যা বলা হতো কারণ রসায়নবিদরা তাদের পরীক্ষা-নীরিক্ষাগুলো গোপনে করতেন। এর কারণ ছিল সাধারণ মানুষ কৌতুুহলি হয়ে তার কাজে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে।
পরবর্তী সময়ে জাবির ইবনে হাইয়ান রসায়ন শাস্ত্রের উপর ১০৮ খানা গ্রন্থ লেখেন। তাঁর মহামূল্যবান গ্রন্থগুলো রসায়ন গবেষণায় সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
উপসংহার: আজকের আর্টিকেলটিতে রসায়ন কাকে বলে তা জানলাম।এছাড়া রসায়নের জনক কে, এটিকে ইংরেজিতে কি বলে,এর ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে জানা হলো। রসায়ন বিষয়টি জটিল হলেও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
কোন জিনিস আবিষ্কার করতে বিশেষ করে চিকিৎসা, মহাকাশযান,পারমানবিক অস্ত্র,ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ও পন্য এরকম অগণিত জিনিসের তৈরিতে ও উন্নতিতে রসায়ন জানা দরকার।
বর্তমান প্রজন্মকে বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী করে তোলার পাশাপাশি রসায়ন নিয়ে পড়ার তাগিদ দিতে হবে। এটা নিয়ে গবেষণা করতে হবে।কারন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই রসায়নের সাহায্যের দরজার। আপনাদের রসায়ন কাকে বলে তা নিয়ে যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানান।