ভোলা জেলার ইতিহাস
ভোলা জেলার আদি নাম ছিল দক্ষিণ শাহবাজপুর। ভোলা গাজি পাটনি নামে এক বৃদ্ধ মাঝি ছিলো। যার নাম অনুসারে এই জেলার নামকরন হয় ভোলা। বর্তমানে প্রশাসনিকভাবে ভোলা শহর ভোলা জেলার প্রশাসনিক সদর দপ্তর। আর ভোলা শহরটিকে দেশের সর্ববৃহৎ শহর গুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে ধরা হয়।
ভোলার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য
ভোলা শহরটি ২২.৬৮৫৯০০° উত্তর এবং ৯০.৬৪৬১১৯° পূর্ব অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এটি মূলত একটি দ্বীপে অবস্থিত যার সমুদ্র সমতল থেকে গড় উচ্চতা ১ মিটার।
উৎপত্তি-
ভোলা বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রাচীন গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এবং একমাত্র দ্বীপ জেলা। জে. সি. জ্যাক তার “বাকেরগঞ্জ গেজেটিয়ার (Bakerganj Gazetier)” এ বর্ণনা করেছেন যে, দ্বীপটি ১২৩৫ সালে তৈরি হওয়া শুরু হয়েছিল। আর এই দ্বীপে ১৩০০ সালে এই অঞ্চলে চাষাবাদ শুরু হয়।
হিমালয় থেকে নেমে আসা ৩টি প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র বাহিত পলি দিয়ে মোহনায় গড়ে উঠেছে এ দ্বীপ। সমুদ্র সমতল থেকে এর গড় উচ্চতা ১২ ফুটের মতো। নৃ-তত্ত্ববিদ ও ভূ-তত্ত্ববিদগণ মনে করেন ‘‘পূর্ব দিকে মেঘনা ও পশ্চিম দিকে তেঁতুলিয়া নদী বঙ্গোপসাগরের মোহনায় এসে গতিবেগ হারিয়ে ফেলে। যারফলে এ স্থানটিতে কালক্রমে পলিমাটি জমা হয়ে আজকের ভোলা নামক দ্বীপটির জন্ম।’’
ভূ-প্রকৃতি-
মেঘনা, তেঁতুলিয়া বিধৌত বঙ্গোপসাগরের উপকূলে জেগে ওঠা এ ভূখন্ডের প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য আছে। সেটি হলো যেদিকে চোখ যায় সব দিকে শুধু সমতল ভূমি দেখা যায়। ফসলের দোলায়মান দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, হরেক রকমের গাছ-গাছালী, পাখির কূজন, বারমাসী ফলমূল সত্যিই উল্লেখযোগ্য।
ভোলা নামকরণের রহস্য
ভোলা গাজি পাটনির নাম অনুসারে এই শহরের নাম হয় ভোলা। স্থানীয়ভাবে প্রচলিত একটি কাহিনী অনুসারে, ভোলা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বেতুয়া নামক খালটি পূর্বে অনেক প্রশস্ত ছিল। সেই নদীতে ভোলা গাজি পাটনির নামক এক বৃদ্ধ মাঝি খেয়া নৌকার সাহায্যে নদী পারাপারের কাজ করতেন। তার নাম অনুসারে এই স্থানের নাম হয় ভোলা।
ভোলা শহরের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ভোলার পূর্বনাম ছিল দক্ষিণ শাহবাজপুর। উনিশ শতকের শুরুর দিকে মেঘনা নদীর সম্প্রসারণের ফলে জেলা সদর থেকে দক্ষিণ শাহবাজপুরের সাথে যোগাযোগ ব্যাহত হতে থাকে। ১৮৪৫ সালে, এই শহরটি নোয়াখালী জেলার অধীনে একটি মহকুমা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। 1869 সালে, ভোলা মহকুমা বৃহত্তর বরিশাল জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। 1876 সালে, প্রশাসনিক সদর দপ্তর দৌলতখান থেকে ভোলা শহরে স্থানান্তরিত করা হয়।
জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্তি: ভোলার নতুন অধ্যায়
ভোলার সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন শাসক ও জলদস্যুদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ভোলার ইতিহাসে জলদস্যুদের অত্যাচার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই অধ্যায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের পূর্বপুরুষদের সাহস ও ত্যাগের কথা। যারা জলদস্যুদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা রক্ষা করেছিলেন।
পর্তুগিজদের অত্যাচার-
1517 সালে, জন ডি সিলবেরা নামক একজন পর্তুগিজ জলদস্যু দ্বীপটি দখল করে নেয়। পর্তুগিজরা এখানে লুটপাট, অত্যাচার ও নারী নির্যাতনের এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলো। তাদের রেখে যাওয়া ভয়ঙ্কর রোমশ কুকুর আজও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে তাদের লোমহর্ষক অত্যাচারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
মনপুরা, আরাকান ও মগ জলদস্যুদের উপদ্রব-
মনপুরা ছিল জলদস্যুদের দস্যুবৃত্তির প্রধান কেন্দ্র। আরাকান ও মগ জলদস্যুরা শাহবাজপুরের দক্ষিণ অংশেও তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে লুটপাট ও নির্যাতনের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছিলো।
জলদস্যুদের অত্যাচারের প্রভাব-
জলদস্যুদের অত্যাচার ভোলার মানুষের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। তাদের লুটপাট ও নির্যাতনের ফলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জনগণের মনে ভীতি ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়।
ভোলার প্রশাসনিক বিবর্তন: 1822 থেকে 1984 সালের ঘটনাবলী
ভোলা জেলার ইতিহাস সম্পর্কে জেনে নিন। অতীতে কেমন ছিলো আপনার প্রিয় ভোলা জেলার ইতিহাস।
প্রাচীন ইতিহাস-
1822 সাল অবধি শাহবাজপুর তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার একটি অংশ ছিল। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে মেঘনা নদীর সম্প্রসারণের কারণে জেলা সদর থেকে দক্ষিণ শাহবাজপুরের সাথে সংযোগ স্থাপন করা কঠিন হয়ে পড়েছিলো। তাই সরকার দক্ষিণ শাহবাজপুর এবং হাতিয়াকে নোয়াখালী জেলার অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।
মহকুমা হিসেবে ভোলা-
1845 সালে ভোলা, নোয়াখালী জেলার অধীনে মহকুমা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তখন এর প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল বর্তমান দৌলতখান। পরবর্তীতে 1869 সালে ভোলা মহকুমা বৃহত্তর বরিশাল জেলার মহকুমায় উন্নীত হয়।
ভোলা শহরের উত্থান-
1876 সালে ভোলা মহকুমার সদর দপ্তর দৌলতখান থেকে ভোলা শহরে স্থানান্তরিত করা হয়। মূলত তখন হতেই ভোলা শহরাঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে।
জেলা হিসেবে ভোলা-
1984 সালে ভোলা মহকুমা স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে উন্নীত হয় এবং ভোলা জেলা শহর হিসেবে মর্যাদা পায়।
বর্তমান ভোলা-
বর্তমানে ভোলা একটি আধুনিক ও সমৃদ্ধ শহর। এখানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বাজার-কর্মশালা, বিনোদন কেন্দ্র ইত্যাদি অবস্থিত। ভোলা তার মিষ্টি দই, লবণ, ইলিশ মাছ এবং নারকেলের জন্য বিখ্যাত।
ভোলার মহিষের দই: ঐতিহ্যের স্বাদ
“দধি, মামলা, গোলা, এই তিনে ভোলা” – এই প্রবাদটি ভোলার তিনটি বিখ্যাত জিনিসের কথা বলে। সেগুলো হলো, দই, মামলা (আইনি বিরোধ) এবং গোলা (ঝড়)। ভোলা দ্বীপ তার মহিষের দই-এর জন্য বিখ্যাত, যা সারা বাংলাদেশের জন্য অন্যতম। আর বহুদিন ধরে চলে আসা ঐতিহ্যবাহী প্রক্রিয়া আজও অপরিবর্তিত রয়েছে।
ভোলা শহরের প্রশাসন: ভোলা পৌরসভা
ভোলা শহরটি ভোলা পৌরসভা নামক একটি স্থানীয় সরকার সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়। এটি ৯টি ওয়ার্ড এবং ১৯টি মহল্লায় বিভক্ত। ৪৫.৪০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ভোলা শহরের ২২.৬৬ বর্গ কিলোমিটার ভোলা পৌরসভা দ্বারা শাসিত হয়।
ভোলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
ভোলা, বাংলাদেশের একটি বৃহত্তম গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ। আর এখানকার সংস্কৃতি বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের সাথে মিল আছে। ভোলার সংস্কৃতি মিশ্র সংস্কৃতি কারণ বরিশাল, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী অঞ্চলের মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাব এখানে লক্ষ্য করা যায়।
ভোলা শহরের ভাষাগত সংস্কৃতি-
ভোলা, বাংলাদেশের একমাত্র জেলা যেখানে নিজস্ব কোনো আঞ্চলিক ভাষা নেই। পশ্চিমের কিছু এলাকায় বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব আছে।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-
ভোলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনেক অনেক প্রাচীন। যাত্রা, পালাগান, নাটক, লোকগান, লোকনৃত্য, ছড়া, গান, কবিতা ইত্যাদি ভোলার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতির অন্যতম উপাদান।
ঐতিহ্যবাহী শিল্প রীতির প্রভাব-
পঞ্চাশের দশক থেকে বিভিন্ন গবেষণাধর্মী লেখায় ভোলার সংস্কৃতি চর্চায় যাত্রা ও নাটকের প্রভাব স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। সেই সময়ে বিদ্যুতের অভাবে হ্যাজাক লাইটের আলোয় গ্রামে-গঞ্জে যাত্রা, পালাগান ও নাটকের আয়োজন করা হতো। এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প রীতি গুলো জনসাধারণের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল এবং ভোলার সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
ভোলা জেলার ইতিহাস বিশেষ বার্তা
এই তথ্য গুলো বিভিন্ন অনলাইন সোর্স থেকে যাচাই করার পর সংগ্রহ করা হয়েছে। তাই আমাদের তথ্য ভুল থাকলে আমাদের টিম অতি দ্রুত সংশোধন করার চেস্টা করবে। কারণ আমরা আপনাকে সঠিক তথ্য প্রদানে সর্বদা প্রস্তুত।
More: দৌলতখান উপজেলার ইতিহাস.