বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন কে?
বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন কে? | বিধবা বিবাহ আইন পাস হয় কার আমলে?
বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন কে হিন্দু ধর্ম সবচেয়ে প্রাচীনতম ধর্ম হওয়ার কারণে এটির রীতিনীতিও অনেক বেশি ও কঠোর বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে। স্বামী মারা যাওয়ার সাথে সাথে একজন নারীর সম্মান শ্রদ্ধা গুরুত্ব বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকতো না। এমনকি একজন নারী সাদা একটি শাড়ি ছাড়া তার সারা জীবনে কোন ভালো কাপড় বা সাজসজ্জা করতে পারতেন না। সাজসজ্জা তো দূরের বিষয় একজন নারীর খাবারের ক্ষেত্রে মাছ, মাংস একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে যেত। বুঝতেই পারছেন সে সময় হিন্দু সমাজে নারীরা কতটা অবহেলিত জীবন যাপন করতো বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন কে।
ঠিক সেই সময়ে আশীর্বাদ হিসেবে সমাজ সংস্কারক ঈশ্বর চন্দ্রের আবির্ভাব হয়। তিনি বুঝতে পারেন পুনরায় বিয়ে না হওয়ার কারণে নারীদের কতটা অমানবিক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। আর এই সমস্যার সমাধানে তিনি বিধবা বিবাহ আইন হিন্দু সমাজে প্রচলন ও বাস্তবায়ন করার জন্য আন্দোলনে নেমে পড়েন। তারপর তার হাত ধরে বাস্তবায়িত হয় এই আইন যা হিন্দু সমাজের নারীদের জীবন আমূলে পাল্টে দেয়। আজকের পোস্টে আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করবো বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন কে, কখন এবং বিধবা বিবাহে আইন প্রচলনে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা কেমন ছিল!!
বিধবা বিবাহ কি?
বিধবা বিবাহ হল এমন একটি রীতি যেখানে একজন নারী পুনরায় বিবাহ করতে পারবেন তার স্বামী মারা গেলে।
বিধবা বিবাহ আইন
বিধবা বিবাহ আইনকে এই শিরোনামে ডাকা হয় “হিন্দু পুনর্বিবাহ আইন ১৮৫৬”। এই আইনটি পাস করার সময় ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড ক্যানিং। সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের ফলে আইনটি পাস হয় ব্রিটিশ শাসনের আমলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অধীন টেরিটোরিয়াল এক্সটেন্ট অঞ্চল লর্ড ক্যানিং দ্বারা পাস বা খসড়াকৃত আইন এটি। এই আইন ১৮৫৬ সালের ২৬ এ জুলাই পাস করা হয় এবং তখন থেকেই ভারতে বিধবা বিবাহ আইনতভাবে শুরু হয় ও সতীদাহ প্রথা একেবারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তনের পূর্বে বিধবাদের অবস্থা কেমন ছিল?
ভারতের কিছু অংশে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী বিধবা বিশেষ করে উচ্চবর্ণ হিন্দু বিধবারা কঠোরতা ও চরমপন্থার জীবন যাপন করবে বলে আশা করা হতো। সে সময় একজন নারী স্বামী মারা যাওয়ার পর পুনরায় বিবাহ করার কোন অনুমোদন ছিল না বা এটি কল্পনা করাও যেত না। বিধবাদের সাদা শাড়ি পড়তে হতো কোন ধরনের সাজ-সরঞ্জাম তারা ব্যবহার করতে পারত না মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ।
অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে তাদের চুল কেটে ফেলতে হতো এবং কখনোই সেই চুল বড় করা যেত না। বিধবাদেরকে ব্লাউজ পড়তেও দেয়া হতো না।
আরো দেখুনঃ
যেকোনো ধরনের উৎসবপূর্ণ জায়গা থেকে পরিবার, সমাজ তাদেরকে বিরত রাখত। তাদেরকে অমঙ্গল মনে করা হতো এজন্য কোন শুভ কাজে তাদেরকে ডাকা হতো না।
আইন প্রতিষ্ঠার পরে বিধবাদের অবস্থা
আইন অনুসারে: “হিন্দুদের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ কোন বিবাহ অবৈধ হবে না, এবং এই ধরনের কোন বিবাহের বিষয়টি অবৈধ হবে না, এই কারণে যে মহিলাটি পূর্বে বিবাহিত ছিল বা এই ধরনের বিবাহের সময় মৃত অন্য ব্যক্তির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিল, হিন্দু আইনের যে কোনো প্রথা এবং কোনো ব্যাখ্যা তা সত্ত্বেও।
আইনে আরও বলা হয়েছে যে বিধবারা যারা পুনর্বিবাহ করে তাদের সমস্ত অধিকার এবং উত্তরাধিকারের অধিকারী ছিল যে মহিলারা প্রথমবার বিয়ে করেন।
আইন অনুসারে, বিধবা তার মৃত স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্ত কোনো উত্তরাধিকার বাজেয়াপ্ত করে। এই আইনটি বিধবাকে বিয়ে করা পুরুষদের আইনি সুরক্ষা প্রদান করে।
বিধবা পুনর্বিবাহ অবশ্য নিম্নবর্ণের লোকদের মধ্যে সাধারণ ব্যাপার ছিল। এই আইনটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় সমাজের সামাজিক সংস্কারে একটি বিপ্লব ছিল।
আইন কার্যকর হওয়ার পর প্রথম বিধবা পুনর্বিবাহ হয়েছিল ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর উত্তর কলকাতায়। বর ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছেলে।
বিধবা বিবাহ আইন পাস হয় কার আমলে?
উনবিংশ শতাব্দীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একজন সমাজ সংস্কারক ছিলেন। সে সময় হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল না। এরপর ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এই আইন পাস করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি হিন্দুদেরকে এটা বোঝান যে শাস্ত্রে বিধবাকে পুনরায় বিয়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে। সে সময়কার হিন্দুরা অনেক গোড়া হিন্দু ছিল। তারা তাদের ধর্ম ও রীতির বাইরে কখনোই কিছু করতে চাইতো না বা সাহস করলেও সমাজ ও পরিবার তা করতে দিত না।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাস হয় লর্ড বেন্টিঙ্কের তত্ত্বাবধানে।
বিধবা বিবাহ আন্দোলনে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা
স্বামী মারা গেলে নারীর জীবন নিষ্প্রাণ হয়ে পড়তো সে সময়কার হিন্দু সমাজে। এর ফলে নারীদের নানা বঞ্চনার শিকার হতে হতো। সমাজের এই অপসংস্কৃতি দূর করা তাই জরুরি হয়ে পড়েছিল। সমাজের এই অপসংস্কৃতি ও অনিয়ম দূর করার জন্য পরবর্তীতে বিদ্যাসাগর কাজ শুরু করেন।
কারণ একজন বিধবার পুনরায় বিবাহের কোন অনুমতি হিন্দু সমাজে ছিল না। ফলে একজন বিধবাকে নিদারুণ কষ্টের জীবন যাপন করতে হতো। স্বামী মারা যাওয়ার পর তার স্বামীর সম্পদে কোনো উত্তরাধিকার ছিল না। নারী যদি বয়সে অল্প হয়েও থাকে তারপরও তার বিয়ে পুনরায় বিবাহের অনুমতি সে সময়কার হিন্দু সমাজ দেয়নি। এর বিরুদ্ধে প্রথম লড়াই শুরু করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যা সাগর। তার চেষ্টায় ব্রিটিশ ভারত সরকার হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন ১৮৫৬ প্রণয়ন করেন। আইনটি বাস্তবায়নের জন্য প্রথমে এগিয়ে আসেন ঈশ্বরচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন।
বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন কে -FAQ
১. বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন কে?
বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন কে হিন্দু সমাজের এই অমানবিক এই রীতিটি নিষিদ্ধ করার জন্য এমন কারো দরকার ছিল যিনি হিন্দু সমাজের গোড়ার সাথে সম্পৃক্ত। ঠিক সেই সময় যিনি এগিয়ে এসেছিলেন তিনি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
২. বিধবা বিবাহকে কে প্রতিষ্ঠা করে?
T Bido remarriage Association যা ও ১৮৫৬ সালেএটি তৈরি হয়েছিল বিষ্ণু শাস্ত্রী পন্ডিত এটি শুরু করেছিলেন।
৩. কে প্রথম বিধবা বিবাহ এর জন্য লড়াই শুরু করেছিলেন?
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের প্রথম সংস্কারক যিনি পুনরায় বিধবা বিবাহের কথা বলেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পরামর্শ দিয়েছিলেন যে বিধবাদের পুনরায় বিবাহের অনুমতি দেওয়া উচিত। পুর্নবিবাহকে সমর্থন করার জন্য তিনি প্রাচীন গ্রন্থগুলির ব্যবহার করেছিলেন। তার পরামর্শে সে সময়ের ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের দ্বারা ১৮৫৬ সালে বিধবা পুর্নবিবাহের অনুমতি দিয়ে আইন পাস করা হয়।
৪. কে বিধবা বিবাহ সমর্থন করেছিলেন?
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন বিখ্যাত ভারতীয় সংস্থারবাদী ও সমাজসেবী। তিনি ব্রাহ্মণবাদী কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং প্রমাণ করেন যে বিধবা বিবাহ বৈদিক শাস্ত্র দ্বারা অনুমোদিত।
৫. কে প্রথম সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করেন?
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রবিধান যা ব্রিটিশ ভারতের সমস্ত বিচার ব্যবস্থায় সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেছিল চার ডিসেম্বর ১৮২৯ সালে। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এই আইডি পাস করেন।
৬. পুনরায় বিবাহের সুবিধা কি?
পুনরায় বিবাহ মানুষিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। মৃত্যু বা বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য সঙ্গী হারানোর পর যারা অবিবাহিত থাকে তাদের তুলনায় যারা পুনর্বিবাহ করে তাদের মধ্যে বিষন্নতার লক্ষণ কম থাকে। পুর্বিবাহিত পুরুষদের মধ্যে পুর্বিবাহিত মহিলাদের তুলনায় কম হতাশাজনক লক্ষণ দেখা যায় তবে উভয় লিঙ্গই এতে উপকৃত হয়।
সমাপ্তি: বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন কে বিভিন্ন দেশ ও বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি বিদ্যমান থাকে। যা একজন ব্যক্তির না মানতে চাইলেও সামাজিক প্রভাব ও সামাজিক চাপের কারণে তাকে ও তার পরিবারকে করতে বাধ্য করা হতো যদিও তা নির্মম হোক না কেন।
এই বিধবা বিবাহ আইন পাস করার এক করুন ইতিহাস রয়েছে প্রথমে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করা হয় তারপরেই এই বিধবা বিবাহ আইন পাস করা হয়। তাই আজ আপনাদের জানানোর চেষ্টা করলাম যে বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন কে এবং তার অবদান কতটা ছিল এই আইন পাশ করার জন্য। কমেন্টের মাধ্যমে আপনি আমাদেরকে জানাতে পারেন হিন্দু সমাজের এই আইন সম্পর্কে আপনার মতামত কি।