ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কি?
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কি? | ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার যোগ্যতা
কারিগরি বা জীবনমুখী শিক্ষা, আমরা প্রায় সকলেই এই শিক্ষাটি সম্পর্কে শুনেছি। যেখানে মূলত তাত্ত্বিক পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবহারিক ক্লাসের মাধ্যমে হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে অধিকাংশ পড়াশোনা একাডেমিক হলেও উজ্জ্বল এবং ব্যতিক্রম হচ্ছে Diploma Engineering এর ক্ষেত্রে। এখানে একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে শিখানোর জন্য ব্যবহারিক ক্লাস করানো হয়।
“থ্রি ইডিয়টস” মুভি দেখেনি এমন লোক সংখ্যা নেহাতই কম। এই মুভিতে আমির খান একটা কথা বলে, যে সকল জিনিস আমাদের জীবনযাত্রা কে সহজ করে তুলে সেগুলোই মেশিন।
ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে জীবন সহজ করা।
বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র একাডেমিক পড়াশোনা করানো হয়। অপরদিকে ডিপ্লোমা পড়াশোনার ক্ষেত্রে সিলেবাসে একাডেমিক ও ব্যবহারিক দুটিই সমান গুরুত্ব পায়। নানান বিষয়ে ডিপ্লোমা পড়ার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশে।
আরো দেখুনঃ টিন সার্টিফিকেট ডাউনলোড.
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিদেশের মত বাংলাদেশেও বর্তমানে হাতেকলমে পড়াশোনা ও কাজের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। পৃথিবীর যে সকল দেশ কারিগরি শিক্ষার প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছে, সেই সকল দেশ তত বেশি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ লাভ করেছে। বর্তমানে চীন কিংবা জাপান এর দিকে তাকালেই এই কথা আমরা উপলব্ধি করতে পারবো।
আর শুধুমাত্র ডিপ্লোমাধারীদের ক্ষেত্রেই না, সাধারণ অনার্স, মাস্টার্স করলেও ফ্রেশারদের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে পার্ট টাইম কাজের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। আর সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি যখন প্রজেক্ট এসাইনমেন্ট সহ বাস্তবিক অভিজ্ঞতা থাকে তখন চাকরি পাওয়া অনেকটাই সহজ হয়ে যায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের। এবার চলুন জেনে নেই, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কি।
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কি? | What is Diploma Engineering
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং হলো ৪ বছর মেয়াদি একটি কোর্স যেখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিত এই সকল বিষয়ের উপর বিষদ পাঠদান করানো হয়। সরকারী ও বেসরকারী পলিটেকনিকেল গুলোতে ৪ বছর মেয়াদি যে ইঞ্জিনিয়ারিং কারিকুলাম রয়েছে তাকেই ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং বলে। Diploma Engineering সাধারণত যারা এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় বা হয়েছে সেসব শিক্ষার্থীরা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য আবেদন করতে পারেন।
কি কি বিষয় নিয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হয়?
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এর উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হলো- সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং, অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। এই বিষয়গুলোর সাথে আমরা অনেক বেশি পরিচিত।
তবে বর্তমান সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পলিটেকনিকেল ইন্সটিটিউট গুলোতে নানা বৈচিত্র্যময় বিষয় যোগ হয়েছে। যেমনঃ ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রিন্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং, গ্রাফিক ডিজাইন, গ্লাস ইঞ্জিনিয়ারিং, সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রো মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, শিপবিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং, সিভিল (উড)ইঞ্জিনিয়ারিং, সার্ভেয়িং, আর্কিটেকচার, কনস্ট্রাকশন, টেলিকমিউনিকেশন, রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং ইঞ্জিনিয়ারিং.
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং, আর্কিটেকচার অ্যান্ড ইন্টেরিয়র ডিজাইন, গার্মেন্টস ডিজাইন অ্যান্ড প্যাটার্ন মেকিং, ইনস্ট্রুমেন্টেশন অ্যান্ড প্রসেস কন্ট্রোল, ডেটা টেলিকমিউনিকেশন অ্যান্ড নেটওয়ার্কিং, এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারিং (অ্যারোস্পেস), এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারিং (অ্যাভিয়োনিকস) এবং মাইনিং অ্যান্ড মাইন সার্ভে টেকনোলজি ইত্যাদি।
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এর মান/ চাহিদা কেমন?
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে একদিকে যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হলে এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। অপরদিকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্ষেত্রে আরও ২ বছর আগেই যে কেউ পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য আবেদন করতে পারেন।
পড়াশোনা শেষে দ্রুত চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা এবং এসএসসি পাশের পরেই আবেদন করা যায় বলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এর চাহিদা প্রচুর। এবার আসি Diploma Engineering এর মান/ চাহিদা প্রসংগে।
জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রত্যেকটি শিক্ষা স্তরের জন্য একটি গ্রেড মান নির্ধারণ করা আছে। যেখানে উচ্চ মাধ্যমিক বা এইচএসসি’র গ্রেড মান ১২। অনার্স, ৩ বছর মেয়াদি ডিগ্রী বা সমমানের গ্রেড মান ১৫, আর ৪ বছর মেয়াদি অনার্স সম্পন্ন করলে গ্রেড মান দাঁড়ায় ১৬। আর এই সবগুলোই এইচএসসি পাশের পর আবেদন করতে হয়।
অপরদিকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এসএসসি পাশের পরপরই আবেদন করা যায় এবং এর গ্রেড মান ১৪।
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার যোগ্যতা
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ যেকোনো শিক্ষার্থী ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। এই ক্ষেত্রে বয়স এবং কোন সালে পাশ করেছেন এরকম কোন সীমারেখা বা ধরাবাঁধা নিয়ম নেই।
আরেকটা অভাবনীয় সুযোগ আছে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্ষেত্রে। সাধারণত আমরা সকলেই জানি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য বিজ্ঞান বিভাগ বা সাইন্স ব্যাকগ্রাউন্ড এর হতে হয়। তবে এখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং। যে কোন বিভাগ থেকে পাশ করেই যে কেউ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হতে পারবেন। ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন এই আইন অনুযায়ী ভর্তি করা শুরু হয়েছে। কারগরি শিক্ষায় দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে আমার মনে হয়।
ভর্তি প্রক্রিয়ায় অন্যান্য উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত পলিটেকনিকেল ইন্সটিটিউটগুলোতে কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
শিক্ষক ,কর্মচারিদের জন্য ২% আসন সংরক্ষিত থাকে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা নাতি নাতনীদের জন্য ৫% এবং এসএসসি ভোকেশনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের জন্য ১৫% আসন বরাদ্ধ থাকে।
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোথায় পড়ানো হয়?
বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট দুই জায়গাতেই ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করা যায়। এছাড়া ইনস্টিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক, বাংলাদেশ সার্ভে ইনস্টিটিউট এবং গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটেও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হওয়া যায়।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৫০ টি সরকারী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আছে, যেখানে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট যেগুলো আছে তার মধ্যে সেরা ইনস্টিটিউট গুলো হলো – ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।
বর্তমানে বেসরকারি ভাবে নিবন্ধিত পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে সঠিক পরিসংখ্যান বলা যাচ্ছে না। তবে এখন পর্যন্ত ৪৩৯ টি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এর হিসাব আছে বলে জানা যায়।
এখানে শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে বলে রাখা ভালো, সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এর চেয়ে বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়াশোনার খরচ তুলনামুলকভাবে অনেক বেশি। তাই বেসরকারি যে কোনো পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়ার আগে তার খরচাদি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে তারপর ভর্তি হওয়া ভালো। অনলাইনে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন গ্রুপ আছে, প্রয়োজনে ঐ সকল গ্রুপ থেকে পোস্ট দিয়েও সিনিয়র ভাইয়াদের পরামর্শ নিতে পারেন।
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আবেদন প্রক্রিয়া
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি সংক্রান্ত সকল নোটিশ পলিটেকনিক শিক্ষা বোর্ড এর অফিশিয়াল ওয়েবসাইট btebadmission.gov.bd থেকে জানা যায়।
একজন শিক্ষার্থী একসাথে ১৫ টি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে অনলাইনের আবেদন এর পূর্বে আবেদন ফি জমা দিতে হবে। আবেদন ফি জমা দেয়ার জন্য বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস যেমন বিকাশ, রকেট, শিউরক্যাশ এর মাধ্যমে আবেদন ফি ২৩৮ টাকা জমা দিতে হয়।
আবেদন এর ক্ষেত্রে কোন ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয় না। এসএসসির ফলাফলের ভিত্তিতেই ভর্তি হতে পারেন শিক্ষার্থীরা।
আবেদন ফর্মে উল্লেখিত পছন্দের বিষয়ের ভিত্তিতে, মেধা এবং কোটা অনুসরণ করে প্রথম বর্ষে ভর্তির জন্য নির্বাচন করা হয়।
ভর্তির সময় এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার মূল নম্বরপত্র বা ট্রান্সক্রিপ্ট সংশ্লিষ্ট পলিটেকনিকেল ইন্সটিটিউটে জমা দিতে হয়।
আরো দেখুনঃ
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কেন পড়া উচিৎ?
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং বেশ কিছু কারণে পড়া উচিৎ বলে অনেকেই ধারণা করেন। যেমনঃ
> দ্রুত চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেই সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করা যায়।
> হাতেকলমে শিক্ষা দেয়া হয় বলে নিজ দেশের পাশাপাশি দেশের বাইরেও এই ডিগ্রীর বেশ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তাই দেশে পড়ালেখা শেষ করে আপনি সহজেই বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ গ্রহণ করতে পারবেন।
> সেশনজট মুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা। অন্যান্য উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে সেশনজটের কারণে মূল্যবান সময়ের অপচয় হলেও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্ষেত্রে তা একেবারেই নেই।
পরিশেষে বলি, বিশ্বায়নের এই যুগে নানাবিধ ইন্ডাস্ট্রির সংখ্যা ক্রমশই বেড়েই চলেছে। আর এই ক্রমবর্ধমান ইন্ডাস্ট্রি ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে বা সময়ের সাথে সাথে খুলে দিচ্ছে। এই দ্বারপ্রান্তে নিজেদের অবস্থান করার এক সম্ভাবনাময় সুযোগ হতে পারে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং।